ইসলামী ব্যাংক নিয়ে বড় দু:সংবাদ

বেসরকারি খাতে দেশের একসময়ের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী ব্যাংক এখন মন্দাকাল অতিক্রম করছে। পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অদক্ষতার কারণে আজ ব্যাংকটি এ অবস্থায় এসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বছরখানেক আগেও ব্যাংকিং খাতের প্রতিটি সূচকে ঈর্ষণীয় সাফল্য নিয়ে ইসলামী ব্যাংক ছিল দেশের ব্যাংকিং খাতের অন্যতম মডেল।

ইতিবাচক ধারায় ছিল ইসলামী ব্যাংক। অপেশাদার গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় ব্যাংকটি এখন আর আগের জায়গায় নেই। আগামীতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন এবং আমানতকারীদের মুনাফা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, মুনাফা না পেলে আমানত উত্তোলনের চাপ আরও বাড়বে। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংকটির অবস্থার আরও অবনতি হবে।

বলা হয়, ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে পরিচালন মুনাফা। ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বছরব্যাপী গুজব, অপপ্রচার, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পতনসহ নানা অস্থিতিশীলতার মধ্যেও বরাবরের মতো ইসলামী ব্যাংক রেকর্ড পরিচালন মুনাফা অর্জন করে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে ব্যাংকটি ক্ষতির সম্মুখীন হতে শুরু করেছে। মার্চ শেষে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির একজন কর্মকর্তা বলেন, এভাবে চললে জুন মাসের পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, আমানতকারীদের মুনাফা দেওয়া সম্ভব হবে না এবং মুনাফা না পেলে আমানত উত্তোলন শুরু হবে। ফলে ব্যাংকের অবস্থার আরও অবনতি হবে।

অপর এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে শ্রেণীকৃত বিনিয়োগ। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের আগে ব্যাংকের শ্রেণীকৃত বিনিয়োগ ছিল সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ। নতুন পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের অনভিজ্ঞ ও অপেশাদার নীতির কারণে ব্যাংকটি এখন ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। সূত্রমতে, সর্বশেষ মার্চ প্রান্তিক শেষে শ্রেণীকৃত বিনিয়োগের হার ৩২ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হবে ১৪ হাজার কোটি টাকা, যেখানে ব্যাংকে আছে মাত্র ৭০০ কোটি টাকা। যে কারণে ব্যাংকটি কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জনে নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবে।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, শ্রেণীকৃত বিনিয়োগের মধ্যে এস আলম গ্রুপের বিনিয়োগ খুবই কম, বড় অঙ্কই অন্য গ্রাহকদের। এস আলম গ্রুপের বিনিয়োগ জুন, সেপ্টেম্বর এবং সর্বশেষ ডিসেম্বরে গিয়ে যখন শ্রেণীকৃত হবে, তখন ব্যাংকের পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, শ্রেণীকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ কমাতে বর্তমান পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই। একটি সূত্র জানায়, বর্তমান কর্তৃপক্ষ ব্যাংকিং ব্যবসার পরিবর্তে প্রমোশন ও পোস্টিং নিয়ে বেশি সময় পার করছে। বিনিয়োগ আদায়ের প্রতি তাদের নজর ক্ষীণ। তারা কেবল বছর শেষে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে বিতরণকৃত বিনিয়োগ নিয়মিত করার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার উদ্ধার প্যাকেজের আশায় সময় পার করছে।

ব্যাংকটির অন্যতম আয়ের মাধ্যম ছিল রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক বাণিজ্য। নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব নেওয়ার পর রেমিট্যান্সে ধস নেমেছে। আগে যেখানে ব্যাংকটি এককভাবে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত রেমিট্যান্স আহরণ করত, সেখানে তা কমতে কমতে ১৬ দশমিক ৪৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়বসাইট থেকেই জানা যায়। রেমিট্যান্স কমার প্রভাবে ব্যাংকের আমদানি বাণিজ্যও নিম্নমুখী। আর রপ্তানিমুখী শিল্প সহায়তার অভাবে ভালো রপ্তানিকারকরা অন্য ব্যাংকে চলে যাচ্ছেন। ফলে রপ্তানি আয়ও নিম্নমুখী। আমদানি-রপ্তানির চালচিত্র বিবেচনায় বৈদেশিক বাণিজ্যে শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকটি এখন পতনের ধারায় চলে গেছে।

এ থেকে উত্তরণের উপায় জানতে কথা বলতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করে রিভলভিং সুবিধা চালু করলে এবং নতুন করে সীমার মধ্যে এলসি খোলার সুযোগ দিলে শ্রেণীকৃত বিনিয়োগ অনেকটাই কমে আসবে। ব্যবসাবান্ধব নয়, এ রকম কিছু সিদ্ধান্তের কারণে পুরো ব্যাকিং খাত এখন ঝুঁকির মখে। শুধু পুনঃতফসিল করে ব্যবসা করার সুযোগ না দিলে তিন মাস পর বিতরণকৃত বিনিয়োগ আবার শ্রেণীকৃত হয়ে পড়বে। এ ছাড়া ঢালাওভাবে বিনিয়োগ ফাইলের দুর্নীতি অনুসন্ধানের কারণে শাখার কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক, জোনপ্রধান ও প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা এবং ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কেউই দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক নন। নিজ দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে কর্মকর্তারা যেকোনোভাবে সময় পার করছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে অনীহার কারণে ব্যাংকটির আরও অবনমন হতে সময় লাগবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।