বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ও সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিব মন্টু। তিনি বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে মন্টুর করা হত্যা মামলায় দীর্ঘদিন কারাগারে থাকা তার মামার জমি দখল করে বানিয়েছেন নিজের আয়না ঘর। জানালা বিহীন প্রায় ৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের এমন সাতটি ঘরের সন্ধান মিলেছে রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের পানিশাইল (নিজগাঁও) এলাকায়।
স্থানীয়রা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে গভীর রাতে কালো রঙের গাড়িতে করে সেখানে লোকজন নিয়ে আসতেন মন্টু। চলে যেতেন আবার ভোররাতে।
সরেজমিনে উত্তরভাগ ইউনিয়নের পানিশাইল (নিজগাঁও) এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার নিজামপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রকিব মন্টু রাজনগরের পানিশাইল (নিজগাঁও) গ্রামে নিজের ও দখলকৃত সম্পত্তিতে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন প্রজাতির বনজ গাছের বাগান। সেখানে নিজের জমি ২ একর ৭ শতাংশ থাকলেও অন্যদের জমি দখল করে ভোগ করছেন মোট ২ একর ৪৭ শতাংশ।
অভিযোগ উঠেছে, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল থাকাকালে বসতবাড়িসহ পাশের সব জমি কেড়ে নিতে মন্টু তার কেয়ারটেকারকে দিয়ে একের পর এক মামলা করিয়েছেন তারই মামা নুরুল ইসলাম কলা মিয়া (৮৩) ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে। মন্টুর জমির পাশেই ছিল তার মামার জমি। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা না পাওয়ায় সেগুলো আর নিতে পারেননি তিনি।
গত ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর রাতের আধাঁরে নিজগাঁও কমিউনিটি ক্লিনিকের পাশে আব্দুর রকিব মন্টুর সম্পত্তির কেয়ারটেকার আব্দুল মালেককে হত্যা করে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে ওই রাতেই পুলিশ গিয়ে নুরুল ইসলাম ও তার পরিবারের সব সদস্যদের ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিব মন্টু বাদী হয়ে রাজনগর থানায় ওই পরিবারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এমনকি নুরুল ইসলামের নাতি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আজিজুর রহমান প্রান্তকেও সেই মালায় গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে নুরুল ইসলামের পরিবারের সবাই কারাগারে থাকার সুযোগে তার বসতঘরসহ সব জমি দখলে নেন মন্টু। পরে নুরুল ইসলামের বসতঘরসহ নিজের জমির সামনের দিকে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেন তিনি। বাড়ির নাম দেন ‘বশির-রাবেয়া কটেজ’। ওই সীমানা প্রাচীরের ভেতরে নির্মাণ করা হয় একচালা টিনের আধাপাকা সাতটি আলাদা আলাদা ঘর। প্রায় ৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের রহস্যজনক এসব ঘরে নেই কোনো জানালা। স্থানীয়রা এই ঘরগুলোকে আখ্যায়িত করেছেন আয়না ঘর হিসেবে।
নিজগাঁও এলাকার বাসিন্দারা জানান, দিনের বেলায় কখনও এসব ঘর খুলতে দেখেননি তারা। তবে গভীর রাতে আব্দুর রকিব মন্টু লোকজন নিয়ে কালো রঙের গাড়িতে করে এখানে আসতেন। আবার ভোররাতের দিকে বেরিয়ে যেতেন। তাকে স্থানীয়রা এতোটাই ভয় পেতেন যে প্রাচীরের ভিতরে যাওয়ার সাহস কেউ করেননি।
পানিশাইল গ্রামের নান্নু মিয়া বলেন, আমরা ছোট থেকে দেখে আসছি নুরুল ইসলাম এই বাড়িতে বসবাস করছেন। আমাদের এলাকায় একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নুরুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যরা জেলে থাকার সময় মন্টু মিয়া তার বাড়ি ও জমিজমা দখল করে নেন। সেখানে জানালাবিহীন আরও ৭টি ছোট ঘর বানিয়েছেন তিনি। রাতের বেলায় এসব ঘরে মন্টু ও তার লোকজন আসতেন। গ্রামবাসী মন্টুর ভয়ে এখানে আসতেন না। আমার মনে হয় আওয়ামী লীগের ‘টর্চার সেল’ আয়না ঘরের মতোই এগুলোর ব্যবহার ছিল। এসব ঘর ভেঙে দেখা দরকার তারা এখানে কি করতেন।
প্রায় আড়াই বছর পর চলতি বছরের জুন মাসে হত্যা মামলা থেকে জামিনে বের হয়ে নুরুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যরা দেখেন বসতঘরসহ প্রায় ৪০ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছেন মন্টু। তাদের রেখে যাওয়া বড় বড় গাছগুলো কেটে নেওয়া হয়েছে। নুরুল ইসলামের জমিতে গড়ে তুলেছেন গাছের বাগান ও ঘর। এছাড়া মন্টুর সীমানা প্রাচীরের ভেতরে তার জমিও ঢুকিয়ে নিয়েছেন।
ওই গ্রামের মানিক মিয়া বলেন, এখানে নিজের ঘরে থেকে নুরুল ইসলাম তার মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তাদের ঘরে নাতি-নাতনি হয়েছে। তার জমির দলিল ও কাগজপত্র আছে। তবুও তাদের সেই ঘরেই থাকতে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে পরিবারটিকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে যাচ্ছেন অ্যাডভোকেট মন্টু। নুরুল ইসলাম যদি হত্যা করে থাকেনও, তাতে তার জমি ও বসতঘর মন্টুর হয়ে যেতে পারে না।
নুরুল ইসলাম কলা মিয়া বলেন, আমি ৭০ বছর এই বাড়িতে থাকছি। আমার বোন ও বোনের ছেলেরা আমাকে স্থায়ীভাবে থাকতে এসব জমি আমার কাছে বিক্রি করেছেন বলে লিখে দিয়েছেন। সব কাগজপত্র আমার থাকার পরও এই জমি কেড়ে নিতে বারবার মামলা দিয়ে আমাকে হয়রানি করেছে মন্টু। পরে আর উপায় না পেয়ে সে নিজেই তার কেয়ারটেকারকে হত্যা করিয়ে আমার পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছে। প্রায় আড়াই বছর জেল খেটেছি। আমার বিবাহযোগ্য কলেজে পড়ুয়া মেয়েও মামলা থেকে বাদ যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নাতিটাকেও ছাড়েনি। এখন জামিনে এসে নিজের ভিটায় প্রবেশ করতে পারছি না। এখনো পুলিশকে দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
কলা মিয়ার নাতি আজিজুর রহমান প্রান্ত বলেন, আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। মন্টুর করা মামলায় দীর্ঘদিন জেলে থাকায় অনুপস্থিতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় আমার ছাত্রত্ব বাতিল করেছে। আমার ছোট খালামনি এইচএসসিতে পড়তো, তাকেও জেলে নেওয়া হয়েছে। বিদেশে থাকা আমার এক মামাকেও আসামি করা হয়েছে। পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছেন এই মন্টু। ৮৩ বছরের বৃদ্ধ নানা অসহায়ের মতো অন্যত্র ভাড়া থাকছেন ৩ মাস ধরে। এখন গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় আমরা বাড়িতে উঠেছি। কিন্তু পুলিশ নানাকে ঘরে ঢুকতে নিষেধ করছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিব মন্টুকে একাধিকবার ফোন করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই তার আর কোনো খোঁজ নেই।
এ ব্যাপারে রাজনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ মো. মুবাশ্বির বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে ওই বৃদ্ধের পরিবারকে ঘরে থাকতে বাঁধা দেওয়া হবে না। জমি নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে আদালতে দুটি মামলা চলমান আছে। বৃদ্ধের ঘরে প্রবেশ করা নিয়ে একজন অভিযোগ করেছিলেন। আমরা বলে দিয়েছি, এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারবো না।
টর্চার সেল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমি শুনেছি। এ বিষয়টি গভীরভাবে আমরা তদন্ত করে দেখবো।
Stat News BD – Most Popular Bangla News The Fastest Growing Bangla News Portal Titled Stat News BD Offers To Know Latest National And Local Stories.